১৩৫ বছরের ঐতিহ্যের নিদর্শন কুমিল্লা টাউন হল ভেঙে নতুন স্থাপনা

ঐতিহ্যে লালিত স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন ১৩৫ বছরের পুরোনো কুমিল্লা টাউন হল (বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন)। এটি ভেঙে নতুন করে বহুতল স্থাপনা নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। 

অবিভক্ত ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজপরিবারের স্মৃতি বহন করা টাউন হলটি কুমিল্লাবাসীর গৌরবেরও প্রতীক। কুমিল্লায় ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধসহ বিভিন্ন স্বাধিকার আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুও ছিল এই টাউন হল। ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত নগরীর প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ে অবস্থিত এই টাউন হলকে কেন্দ্র করেই বিকশিত হয়েছে কুমিল্লার শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, আর্থসামাজিক ও কল্যাণমুখী নানান কাজ।

এখানে পদধূলি পড়েছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মহাত্মা গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতো মহাত্মজনের।

এসব স্মৃতিচিহ্ন ধুলায় মিশিয়ে দেওয়ার আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। কালের সাক্ষী ১৩৫ বছরের পুরোনো সেই বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তনকে ভেঙে নতুন স্থাপনা তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে প্রশাসন। এ নিয়ে কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে লেখক-শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীরা সমালোচনামুখর হয়েছেন। তাদের দাবি- টাউন হলটি ভেঙে ফেলা হলে কুমিল্লার ইতিহাস-ঐতিহ্যে আঘাত করা হবে। তাদের ভাষ্য, সবাই আধুনিক সুযোগ-সুবিধা চায়, উন্নয়ন চায়। তবে সেটা ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে নয়।

প্রস্তাবিত বহুতল ভবনে পাঠাগার, একাধিক মিলনায়তন, মহড়াকক্ষ, ভিআইপি লাউঞ্জ, অতিথি কক্ষ, দ্বিতল গাড়ি পার্কিং, প্রবেশ ও বাইরের আলাদা সড়ক, ক্যানটিনসহ নানা ধরনের কক্ষ থাকবে। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজপরিবারের স্মৃতি বহন করা টাউন হলটি কুমিল্লাবাসীর গৌরব ও প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতীক।

কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি কুমিল্লা-৬ (আদর্শ সদর, সিটি করপোরেশন ও ময়নামতি সেনানিবাস এলাকা) আসনের সাংসদ আ ক ম বাহাউদ্দিন কুমিল্লা টাউন হলের বর্তমান স্থাপনা ভেঙে নতুন করে বহুতলবিশিষ্ট আধুনিক স্থাপনা করার জন্য সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একটি ডিও দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতেই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় গণপূর্ত বিভাগকে কুমিল্লা টাউন হল নিয়ে একটি নকশা করার জন্য বলে।

গত বুধবার দুপুরে এ নিয়ে কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলনকক্ষে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক ও কুমিল্লা টাউন হলের সভাপতি মো. আবুল ফজল মীরের সভাপতিত্বে এক সভা হয়। সভায় সাংসদ আ ক ম বাহাউদ্দিন, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. মনিরুল হক, পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক মো. আতাউর রহমান, ইতিহাসবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা গোলাম ফারুক, জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আহসান ফারুক রোমেন, কুমিল্লা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আবুল হাসনাত বাবুল, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক নীতিশ সাহাসহ বিভিন্ন পেশার ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে স্থপতি মো. আসিফুর রহমান ভূঁইয়া বহুতল ভবন নির্মাণের নকশার ডিজিটাল অ্যানিমেশন উপস্থাপন করেন। 

তবে বৈঠকে উপস্থিত সুধীসমাজের অনেকেই মত দিয়েছেন- টাউন হল ভবনের স্থাপত্যশৈলীটি ঠিক রেখে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হোক।

পুরোনো এ স্থাপনাটি রক্ষার দাবি জানিয়ে নাট্যজন ও ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের (আইটিআই) সাম্মানিক সভাপতি রামেন্দু মজুমদার বলেছেন, আমি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র ছিলাম। আমার জীবনের অনেক সময় কেটেছে এই টাউন হলকে ঘিরে। আমাদের সবার দায়িত্ব ইতিহাস-ঐতিহ্যের এসব স্থাপনা রক্ষা করা। কোনোভাবেই এটাকে ভেঙে ফেলা যাবে না। প্রয়োজনে অন্য জায়গায় আধুনিকায়ন করা হোক।

কবি ও লেখক পিয়াস মজিদের শৈশব-কৈশোর কেটেছে এই টাউন হলকে ঘিরে। তিনি বলেন, বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন কুমিল্লার প্রত্নতত্ত্বের ঐতিহাসিক এক নিদর্শন। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজপরিবারের সদস্য মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুরের হাতে প্রতিষ্ঠিত এই স্থাপনা ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সেতুবন্ধন। বীরচন্দ্র গণপাঠাগারে রয়েছে সেরা সব বইয়ের সংগ্রহ। অনেক বড় বড় মনীষী এখানে এসে বিভিন্ন সময় কথা বলেছেন। এই টাউন হলের মঞ্চেই নাটক করেছেন ভাষাসংগ্রামী লায়লা নুরসহ অসংখ্য গুণী শিল্পী। দুই বাংলার এমন কোনো আবৃত্তি শিল্পী নেই, যারা এ টাউন হলের মঞ্চে এসে আবৃত্তি করেননি। আধুনিকায়নের নামে ১৩৫ বছরের এই স্থাপনা কোনোভাবেই ভেঙে ফেলা যাবে না।

কবি ও অ্যাকটিভিস্ট শাহেদ কায়েস ফেসবুকে আত্মবিধ্বংসী এমন উদ্যোগের প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, 'আমরা উন্নয়ন চাই, তবে এমন ঐতিহ্যনাশী উন্নয়ন কখনোই চাই না। ঐতিহ্য বিধ্বংসী এ উদ্যোগের প্রতিবাদ জানাই, এ ঐতিহ্যনাশী উন্নয়ন থামাতে সম্মিলিত প্রতিবাদ জরুরি।'

কুমিল্লার ইতিহাসবিদ ও গবেষক অ্যাডভোকেট গোলাম ফারুক বলেন, গত বুধবারের ওই সভায় আমিও ছিলাম। আমি সভায় বলেছি নতুন স্থাপনা করেন, এতে কোনো আপত্তি নেই। তবে নতুনের সঙ্গে পুরোনো ঐতিহ্য এই স্থাপনা থাকতে হবে। ব্রিটিশ স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন ও নান্দনিকতা রয়েছে এ বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তনে। নতুন স্থাপনার সঙ্গে এই নান্দনিকতা থাকতে হবে। যুগের সঙ্গে পরিবর্তন দরকার, তবে আধুনিকতার সঙ্গে ঐতিহ্যকে সংযুক্ত করতে হবে।

'কুমিল্লার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি' গ্রন্থের লেখক আহসানুল কবীর বলেন, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা সময়ের দাবি। তবে সেটা কোনোভাবেই ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে নয়। বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন কুমিল্লাবাসীর গর্ব ও অহংকারের প্রতীক। এখান থেকেই সব আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশের এমন কোনো মনীষী ও গুণী ব্যক্তি নেই, যারা এখানে আসেননি। এমন একটি ঐতিহ্যকে আমরা শেষ করে দিতে পারি না।

Share this post

PinIt
scroll to top